স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছিন্নতায় ১৬ শতাংশ পরিবার
স্বামীর কর্মসংস্থান, শিক্ষা কিংবা অভিবাসনের মতো কারণে অনেক নারীকে আলাদা থাকতে হয়। বাংলাদেশের নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ১৬ শতাংশ। নৃবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বামী ও স্ত্রী আলাদা থাকার কারণে ব্যাহত হচ্ছে আদর্শ পরিবার গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া। বিশেষ করে সমাজের আদিম এ প্রতিষ্ঠানের মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্যগুলো নানাভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
নৃবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী দুই পক্ষেরই সমান ভূমিকা রয়েছে। এখানে এক পক্ষের শারীরিক অনুপস্থিতি আদর্শ পরিবার গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সন্তানের শিক্ষা, নৈতিকতা ও সম্মানবোধ।
স্বামী থেকে আলাদা বসবাস করা নারীদের তথ্য উঠে এসেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) সর্বশেষ জরিপে। এর নাম ‘বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (২০২২)’। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিবাহিত নারীদের ১৬ শতাংশ স্বামী থেকে পৃথক থাকছেন। সবচেয়ে বেশি আলাদা থাকতে হয় গ্রামাঞ্চলের নারীদের। তাদের মধ্যে এ হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। শহরে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। শিক্ষা ও অর্থনীতির মানদণ্ডে উচ্চ শিক্ষিত ও ধনী পরিবারের নারীদের মধ্যে এ হার বেশি।
জরিপে দেখা গেছে, স্বামী থেকে পৃথক থাকার হার সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে। এ বিভাগের প্রায় ২৮ শতাংশ নারী স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকেন। এছাড়া বরিশালে ২০ শতাংশ, সিলেটে ১৮, ঢাকায় ১৫, ময়মনসিংহে ১৩, খুলনায় ১২, রাজশাহীতে ১০ ও রংপুর বিভাগে ৯ শতাংশ।
৩৮ শতাংশ বিবাহিত নারী জানান, তাদের স্বামীরা (জরিপকাল থেকে) গত এক বছরের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে একবারও সাক্ষাৎ করেননি। এই হার শহরে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ। গ্রামে ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ। ৪১ শতাংশ নারীর স্বামী বছরে এক থেকে পাঁচবার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বছরে ছয় থেকে ১১ বার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতে এসেছেন ১১ শতাংশ স্বামী। আর প্রতি মাসে এক বা একাধিকবার পরিবারের সাক্ষাৎ পেয়েছেন ১১ শতাংশ স্বামী।
পরিবারকে সামাজিকীকরণের প্রথম ধাপ বলে অভিহিত করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শিশুরা সমাজ, ধর্ম, নৈতিকতা, সৌন্দর্য, সম্মানবোধ ও ভালোবাসা শেখে পরিবারের কাছ থেকে। আমরা বিষয়টিকে পারিবারিক শিক্ষা বলি। ধরে নিলাম বাবার অনুপস্থিতিতে শিশু মায়ের কাছে সঠিকভাবে বড় হচ্ছে। আদর্শ মা হয়ে সন্তানকে সঠিকভাবে লালন-পালন করছেন। তবে বাবার অনুপস্থিতিতে ওই শিশু বাবার আদর, সোহাগ ও শাসন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাবার অনুপস্থিতিতে শিশুর নৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। একটা পরিবারে মা-বাবার সমন্বিত অবস্থান শিশুর বেড়ে ওঠায় সহায়ক। শিশুর মানসিক বিকাশেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।’
পরিবার থেকে স্বামীর বিচ্ছিন্ন থাকার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও বিদেশমুখিতার মতো কারণও দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান এ শাফী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব নারীর সঙ্গে স্বামীর আইনি সম্পর্ক নেই, সেসব পরিবারে নারী প্রধান। নারী অন্যান্য কারণেও পরিবারের প্রধান হতে পারেন। যেমন স্বামী কাজের জন্য বিদেশে গেলে। পরিবারের প্রতিটি কার্যক্রমে স্বামী ও স্ত্রীর সমন্বিত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হয়। স্বামী ও স্ত্রী আলাদা থাকলে সমন্বিত সিদ্ধান্ত হয় না। এতে সামাজিক দিক দিয়ে ওই পরিবার নানা সমস্যায় পড়ে।’
অধ্যাপক হাসান এ শাফী বলেন, ‘এক একটি পরিবার এক একটি ইনস্টিটিউশন। যেসব শিশু বাবাকে কাছে পায় না, সেসব শিশু সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে যায়। একটি পরিবারের যে উদ্দেশ্য থাকে, তা ব্যাহত হয়। সন্তান জন্ম দেয়া এবং তাদের সামাজিকীকরণের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুরা শিক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে। সামাজিক রীতিনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন সঠিকভাবে হয় না।’
পরিবারের যে প্রক্রিয়া তা সহজ নয় উল্লেখ করে নৃবিজ্ঞানের এ অধ্যাপক বলেন, ‘পরিবারের সব সদস্য যখন সঠিকভাবে কার্যক্রম করতে পারেন না, তখন পরিবার গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। স্ত্রী ও স্বামীর ভূমিকার সমন্বয় খুবই জরুরি। বাবার কাছ থেকে নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা থেকে শিশুরা বঞ্চিত হয়। বয়ঃসন্ধিকালে বাবাকে না পেলে সহিংসতা ও মাদক গ্রহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরিবার একটি সামাজিক কাঠামোর একক। যখন একটি পরিবার সঠিকভাবে গড়ে ওঠে না, তখন ওই পরিবার সমাজের অন্যান্য পরিবারের সঙ্গেও যুক্ত হতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে।’
বাংলাদেশের পরিবারের কাঠামো পুরুষতান্ত্রিক। ফলে পরিবারপ্রধানের অনুপস্থিতিতে অন্য সদস্যদের চিকিৎসাসেবাও বাধাগ্রস্ত হয়। উদাহরণ হিসেবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মানুষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগের হার বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে কখনো এক বছর বা তিন বছরের জন্য ধারাবাহিক চিকিৎসা নিতে হয়। এতে পরিবারের প্রধানের ভূমিকা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনও দেখা যায় অনেক নারী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। কিন্তু স্বামী কাছে না থাকার কারণে তার চিকিৎসা পেতে বিলম্ব হচ্ছে। আবার বাবা না থাকার কারণে হাসপাতালে অনেক শিশু চিকিৎসার জন্য দেরিতে আসছে।
অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সমাজ বদলে যাওয়ার কারণে নারী-পুরুষের পরিবার থেকে পৃথক হতে হচ্ছে। এ সংকট মোকাবেলায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি দেখা যাচ্ছে না। মাইগ্রেশনের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে বেশি।’