খাদ্যে ক্ষতিকর ধাতব কিভাবে ঢোকে, শরীরের কী ক্ষতি করে

শেয়ার করুন

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে জামালপুর জেলার কুড়িটি এলাকায় চাষ করা বেগুনে ক্ষতিকর সীসা, ক্যাডমিয়াম ও নিকেলের উপস্থিতি রয়েছে।

এর আগে নানা সময়ে মুরগি, মাছ, দুধ, হলুদের গুড়োতেও ক্ষতিকর ধাতবের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিছু খাদ্যে মাত্রার চাইতে বেশি পারদ ও আর্সেনিক পাওয়া নিয়েও কথা হয়েছে।

খাদ্যে এসব ধাতব পদার্থ মাত্রার চাইতে বেশি থাকলে এবং নিয়মিত খেলে তা মানুষের শরীরে নানা ধরনের জটিল অসুখ তৈরি।

খাদ্যে ক্ষতিকর ধাতব কিভাবে আসে?

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আসাদুজ্জামান খান এ প্রসঙ্গে গবেষণা করেছেন। তিনি বলছেন, কৃষি পণ্যে ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ আসতে পারে মাটি ও পানি থেকে। কোন নির্দিষ্ট সবজি বা গাছের সাথে এর সম্পর্ক নেই।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “মাটি বা পানিতে নানা কারণে এসব ধাতব পদার্থের দূষণ হতে পারে। যেমন কোন কারখানা থেকে নিয়মিত যদি বর্জ্য পরিশোধন না করে মাটিতে ফেলা হয়, সেই মাটিতে আপনি যা চাষ করবেন ওই বর্জ্যে যেসব ধাতব পদার্থ থাকবে সেই ফসলে ওই সেসব পাওয়া যেতে পারে।”

“যদি সেই বর্জ্য পানিতে ফেলা হয় এবং ঐ পানি যদি কৃষিতে সেচের কাজে ব্যাবহার করা হয় তাহলে ফসলে ওই বর্জ্যে উপস্থিত ধাতব পাওয়া যেতে পারে। আবার পানিতে ধাতব পদার্থের দূষণ থাকলে সেটা ধীরে ধীরে আশপাশের মাটিকেও দুষিত করে ফেলে।”

মাটি বা পানিতে ধাতব পদার্থের দূষণের ফলে ফসলে ক্ষতিকর ধাতব পাওয়া যেতে পারে।

অধ্যাপক খান উদাহরণ দিয়ে বলেন, তিনি বাংলাদেশের আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় ধানে আর্সেনিক পেয়েছেন। যেসব এলাকায় শিল্পদূষণ বেশি তার আশপাশে চাষ করা কৃষিপণ্যে ক্ষতিকর ধাতব বেশি পাওয়া গেছে।

আয়তনে ছোট হওয়ার কারণে এবং কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে কৃষি জমির আশপাশে শিল্প কারখানা খুবই নিয়মিত দেখা যায়। অন্যদিকে নদী বা জলাশয়ে পরিশোধন না করেই বর্জ্য ফেলার প্রবণতাও বাংলাদেশে ব্যাপকহারে রয়েছে।

“এখন নির্দিষ্ট একটি এলাকার বেগুনে ক্ষতিকারক ধাতব পাওয়া গেছে তার অর্থ এই নয় যে সারা দেশে সকল বেগুনে তা পাওয়া যাবে। ফসলটি কোথায় চাষ করা হচ্ছে, সেখানকার মাটি কেমন বিষয়টি তার উপর নির্ভর করবে”, বলছিলেন অধ্যাপক খান।

সার, কীটনাশক, বায়ুদূষণ

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ খাদ্য ও কৃষি নিয়ে গবেষণা করছে উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা, উবিনিগ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলছেন, খাদ্যে ধাতবের আরও তিনটি উৎস হল কিছু সার, কীটনাশক, আগাছা নিধনকারী ঔষধ এবং বায়ু দূষণ।

তিনি বলছেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ১৩টি কীটনাশক আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। সেগুলোর বেশ কয়েকটি বাংলাদেশে অবাধে বিক্রি হচ্ছে, ব্যবহৃত হচ্ছে। কোন ধরনের সরকারি নজরদারি নেই। ডিলাররা যেভাবে বলে দিচ্ছে কৃষকেরা সেভাবে ব্যাবহার করছে। যার মাত্রা প্রায়শই বেশি হয়ে থাকে।

“এছাড়া হাইব্রিড ফসলে কীটনাশক বেশি দিতে হয়। এসব কারণে মাটিতে ক্ষতিকর ধাতব বেশি পাওয়া যায়। বাতাসে যদি সীসা বেশি থাকে তাহলে ফসলে তার উপস্থিতি পাওয়া যেতে পারে।”

বাংলাদেশে ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করছেন অনেক কৃষক।

তিনি আরও বলছেন, অসময়ে অন্য মৌসুমের সবজি চাষেও কীটনাশক ও সার বেশি দেবার প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত নিষিদ্ধ এরকম কয়েকটি কীটনাশক হচ্ছে প্যারাকোয়াট, ডিডিটি এরকম কয়েকটি কীটনাশক হচ্ছে

“যেমন ধরুন আপনি গরমের দেশের মানুষ হঠাৎ শীতের দেশে গেলে অনেক শীত লাগবে না? সেরকম শীতকালীন একটা সবজি আপনি আগাম চাষ করলেন কিন্তু আবহাওয়া তার উপযোগী নয় তখন তার অসুখ হবে বেশি। সেরকম হলে তাই কীটনাশকও লাগবে বেশি।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে পুরনো দিনের কিছু কীটনাশক যেগুলো কম দামে পাওয়া যায় সেগুলো দীর্ঘদিন মাটিতে থেকে যেতে পারে, পানি দূষণের কারণ হতে পারে। একই জমিতে বছরের পর বছর এসব কীটনাশক ব্যবহার করলে সেটি ঘটতে পারে।

উন্নয়নশীল, অনুন্নত দেশ এবং খাদ্যে ঘাটতি রয়েছে এমন দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এসব কীটনাশক সহায়তা করলেও তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও যেসব খাদ্যে ক্ষতিকর ধাতব

কাছাকাছি সময়ে বেগুন ছাড়াও নানা সময়ে আরও বেশ কিছু খাদ্যে ক্ষতিকর ধাতব পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে হলুদের গুঁড়োতে অতিমাত্রায় ক্ষতিকারক সীসার উপস্থিতি পাওয়ার পর হলুদ রপ্তানি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল।

সেসময় বেশ কয়েকটি বড় বড় কোম্পানির হলুদের গুড়োতে এর উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। বিক্রির আগে হলুদের গায়ে সীসা ঘষে সেটি উজ্জ্বল করার কারণে হলুদের গুঁড়োতেও সীসা পাওয়া যাচ্ছিল।

একই বছর দুধে সীসাসহ ভারী ধাতুর উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়। মুরগি ও মাছ চাষে ট্যানারির বর্জ্য থেকে তৈরি খাবার দেয়ার বিষয়টি জানা গেছে কয়েক বছর আগে। এসব ধাতব পদার্থের উপস্থিতি নিয়ে সেসময় বেশ উদ্বেগ তৈরি হয়।

বাংলাদেশে হলুদের গুঁড়োতে অতিমাত্রায় ক্ষতিকারক সীসার উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল।

নিয়মিত খেলে শরীরে যে ক্ষতি হয়

পরিপাকতন্ত্রের নানা রোগ বিষয়ে চিকিৎসক গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ বলেন, খাদ্যে এসব ক্ষতিকর ধাতবের উপস্থিতি সহনশীল মাত্রার ভেতরে আছে কিনা সেটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

“যেসব ক্ষতিকর ধাতব নিয়ে এখন আলোচনা চলছে সেগুলো যদি আপনি একদিন একটু বেশি খেয়ে ফেলেন তাহলে হয়ত পেটে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া হতে পারে। কিন্তু যদি নিয়মিত সেটা পেটে যায় তাহলে তার প্রভাব মারাত্মক হবে। যেমন আপনার লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্যান্সার হতে পারে। খাদ্য যে জায়গা থেকে প্রবেশ করে, পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে যায় সেসব অংশে ক্যান্সার হতে পারে”, বলছিলেন ডা. ফারুক আহমেদ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃতিতে অল্প পরিমাণে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু দূষণের কারণে প্রকৃতিতে তা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাডমিয়াম কিডনি, হাড় ও শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করে।

সীসা সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে শিশুদের। মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। এছাড়া, খাবারে অরুচি, ওজন কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ – এরকম নানা সমস্যা তৈরি করে।

পারদ শরীরে বেশি প্রবেশ করলে তা স্নায়ু, পরিপাকতন্ত্র, কিডনি, ফুসফুস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষতি করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *